বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতে প্রবাসী শ্রমিকদের অবদান অবিচ্ছেদ্য। তাঁদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে স্থিতিশীল রাখে, যা জাতীয় উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এই সাফল্যের পেছনের গল্পটি প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়। বিদেশ বিভুঁইয়ে প্রবাসী শ্রমিকদের জীবনের ঝুঁকি, তাঁদের অধিকার এবং তাঁদের সুরক্ষার অভাব প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে, প্রবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিতকরণে সরকারের ভূমিকা অপরিহার্য।
আমরা আমাদের গবেষণায় দেখেছি প্রবাসী শ্রমিকরা বিদেশে যেসব ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- শ্রমিক পাচার ও অবৈধ অভিবাসন: দালালদের মাধ্যমে প্রতারিত হয়ে অনেকে অবৈধ পথে বিদেশে যান এবং সেখানে মানবেতর জীবনযাপন করেন।
- নিম্নমানের কর্মপরিবেশ: অনেক শ্রমিককে অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে হয়, যা তাঁদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
- বেতন ও কর্মঘণ্টার বৈষম্য: চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বেতন না পাওয়া, অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য হওয়া এবং সময়মতো বেতন না পাওয়ার অভিযোগ প্রায়শই শোনা যায়।
- আইনি সুরক্ষার অভাব: অনেক সময় আইনি প্রক্রিয়ার জটিলতা বা ভাষার সমস্যার কারণে তাঁরা আইনি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হন।
- সামাজিক ও মানসিক চাপ: পরিবার থেকে দূরে থাকার কারণে তাঁরা মানসিক চাপ এবং একাকীত্বে ভোগেন।
সরকার এই সমস্যাগুলো সমাধানে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারে। এই পদক্ষেপগুলো দুটি ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে: অভিবাসন-পূর্ববর্তী এবং অভিবাসন-পরবর্তী।
অভিবাসন-পূর্ববর্তী পদক্ষেপ:
১. সচেতনতা বৃদ্ধি: সরকারি উদ্যোগে প্রতিটি উপজেলায় অভিবাসন সংক্রান্ত তথ্য কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে। এই কেন্দ্রগুলোতে বৈধ উপায়ে বিদেশ যাওয়া, দালালদের থেকে সাবধান থাকা, কাজের চুক্তিপত্র ভালোভাবে যাচাই করা এবং সংশ্লিষ্ট দেশের আইন সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেওয়া হবে।
২. দক্ষতা বৃদ্ধি: বিদেশে যাওয়ার আগে শ্রমিকদের জন্য কারিগরি ও ভাষা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। দক্ষ জনশক্তি পাঠাতে পারলে তাঁদের আয় বাড়বে এবং তাঁদের অধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকি কমবে।
৩. স্বচ্ছ প্রক্রিয়াকরণ: অভিবাসন প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ করতে অনলাইন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এতে করে দালালদের প্রভাব কমবে এবং শ্রমিকরা সরাসরি সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন।
অভিবাসন-পরবর্তী পদক্ষেপ:
১. দূতাবাসের ভূমিকা শক্তিশালীকরণ: বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে শ্রমিকদের আইনি ও মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। দূতাবাসগুলোতে বিশেষ ‘শ্রমিক ডেস্ক’ স্থাপন করে ২৪/৭ হটলাইন সেবা চালু করা যেতে পারে।
২. আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব: যেসকল দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকরা কাজ করেন, সেসব দেশের সরকারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে শ্রমিকদের অধিকার ও মজুরি নিশ্চিত করতে হবে।
৩. আইনি সহায়তা প্রদান: নির্যাতিত শ্রমিকদের জন্য আইনি সহায়তা প্রদান এবং তাঁদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা।
৪. বীমা সুবিধা: প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য একটি বাধ্যতামূলক বীমা স্কিম চালু করা যেতে পারে, যা তাঁদের স্বাস্থ্যসেবা, দুর্ঘটনা বা মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ এবং অন্যান্য আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করবে।
প্রবাসী শ্রমিকরা শুধু রেমিট্যান্সের উৎস নন, তাঁরা আমাদের দেশের গর্ব। তাঁদের ত্যাগ ও পরিশ্রমের প্রতি সম্মান জানানো এবং তাঁদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। সরকারের যদি একটি সমন্বিত ও কার্যকর কৌশল থাকে, তবেই কেবল তাঁদের জীবনমান উন্নত হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে তাঁদের অবদান আরও শক্তিশালী হবে। প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা করে আমরা কেবল তাঁদেরই নয়, বরং সমগ্র জাতির মর্যাদা বৃদ্ধি করব।