খাবার খেতে বসে ক্যালরি গোনা আর খাবার শেষে অবিরাম কার্ডিও করার কথা ভুলে যান! নতুন গবেষণা ইঙ্গিত দিচ্ছে ওজন কমানোর রহস্য আপনার শরীরের অনেক গভীরে লুকিয়ে আছে। বলা হচ্ছে মস্তিষ্কের মত আমাদের কোলনেরও আছে “ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়”! বিজ্ঞানীরা আমাদের অন্ত্র এবং মস্তিষ্কের মধ্যে একটি যোগাযোগের পথ খুঁজে পেয়েছেন যা ওজন কমানো বা বাড়ানোর কৌশলগুলোকে সম্পূর্ণ পাল্টে দিতে পারে।

ডিউক ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ মেডিসিনের স্নায়ুজীববিজ্ঞানীদের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি যুগান্তকারী গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের কোলনের ভেতরে থাকা “নিউরোপডস” নামক ক্ষুদ্র সেন্সর কোষগুলো সাধারণ ব্যাকটেরিয়াল প্রোটিন শনাক্ত করতে পারে এবং দ্রুত মস্তিষ্ককে সংকেত পাঠাতে পারে। এই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াকে “নিউরওবায়োটিক সেন্স” বলা হচ্ছে। কখন যথেষ্ট খাওয়া হয়েছে তা আমাদের শরীরকে জানাতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের শরীর ক্ষুধা দমন করে এবং অতিরিক্ত খাওয়া প্রতিরোধ করে।
বছরের পর বছর ধরে, আমরা জানি যে অন্ত্র এবং মস্তিষ্কের মধ্যে একটি সংযোগ রয়েছে, যাকে প্রায়শই “অন্ত্র-মস্তিষ্ক অক্ষ” বলা হয়। আমরা এতদিন জানতাম হরমোন প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে এই যোগাযোগ ঘটে। তবে, এই নতুন আবিষ্কার সরাসরি স্নায়বিক ও রাসায়নিক কার্যক্রমটিকে আমাদের কাছে পরিষ্কার করে দিয়েছে। এখন আমরা জানতে পারলাম আমাদের মস্তিষ্ক কিভাবে নিম্ন পাচনতন্ত্রে কী ঘটছে তার সরাসরি ও তাৎক্ষণিক আপডেট পায়।
এই “ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের” মূল খেলোয়াড় বলে মনে করা হয় একটি প্রোটিনকে যার নাম ফ্ল্যাজেলিন। ফ্ল্যাজেলিন বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার লেজে পাওয়া যায়। যখন কোলনে থাকা নিউরোপডগুলো ফ্ল্যাজেলিন শনাক্ত করে, তখন তারা শুধু বসে থাকে না বরং দ্রুত PYY নামক একটি নিউরোকেমিক্যাল মুক্ত করে। এই রাসায়নিক তখন ভেগাস নার্ভের মাধ্যমে মস্তিষ্কের ক্ষুধা-দমনকারী নিউরনগুলিকে সক্রিয় করে তোলে। অর্থাৎ কিনা কোলন আমাদের মস্তিষ্ককে বলে, যথেষ্ট খাওয়া হয়েছে এবার তোমার খাওয়া থামাও।
একটি পরীক্ষায় ইঁদুরদের কোলনে সরাসরি অল্প পরিমাণে ফ্ল্যাজেলিন দেওয়া হয়েছিল। ইঁদুরগুলো জেনেটিকভাবে পরিবর্তিত ছিল। এই ইঁদুরদের নিউরোপডগুলিতে ফ্ল্যাজেলিন শনাক্তকারী নির্দিষ্ট রিসেপ্টর (TLR5) ছিল না। তাই এই ইঁদুরগুলো বেশি খেতো। বেশি খেয়ে খেয়ে অনেক বেশি ওজন অর্জন করে ফেলেছিল। ফ্ল্যাজেলিন প্রয়োগ করার পর দেখা গেলো ফ্ল্যাজেলিনের প্রভাবে ইঁদুরগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে কম খাচ্ছে।

এটি অনেকটা আমরা যেভাবে আমাদের অন্যান্য ইন্দ্রিয় – দেখা, শোনা, গন্ধ নেয়া, স্বাদ নেওয়া এবং স্পর্শ করার জন্য ব্যবহার করি তার মতোই কাজ করে। তবে এটি একটি অপ্রত্যাশিত জায়গা থেকে কাজ করে: আমাদের অন্ত্র থেকে।
ড: দিয়েগো বোহোরকেজ
এই “নিউরওবায়োটিক সেন্সকে” বোঝা কেবল হজমের জন্য নয়; এটি আমাদের মাইক্রোবায়োম কীভাবে খাদ্যাভ্যাস, আকাঙ্ক্ষা এমনকি মেজাজকে প্রভাবিত করতে পারে সেটি বোঝার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, মস্তিষ্ক ও অন্ত্রের মধ্যকার এই যোগাযোগ পদ্ধতিটিকে বোঝা এবং সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করার উপায় বের করার মাধ্যমে স্থূলতা এবং অন্যান্য ক্ষুধা-সম্পর্কিত রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব। এর জন্য নতুন নতুন অনেক কৌশল উদ্ভাবিত হতে পারে। আমরা এমন একটি ভবিষ্যত কল্পনা করতে পারি যখন খাদ্যের পরিবর্তন বা এমনকি টার্গেটেড থেরাপির মাধ্যমে কোলনের “ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়” কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো। আর তা সম্ভব হলে স্বাস্থ্যকর উপায়ে ওজন কমানো বা বৃদ্ধির উপায়ও সহজে পরিকল্পনা করা যাবে।
যদিও মানবদেহে ওজন কমানোর জন্য এই আবিষ্কারের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা উন্মোচন করতে আরও গবেষণা প্রয়োজন, তবে এটি আমাদের অন্ত্রের জীবাণু এবং আমাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের মধ্যে যে একটা গভীর যোগাযোগ আছে তা প্রমাণ করতে পেরেছে। এতদিন মনে করা হত পেট ভরে খেলে মস্তিষ্ক আপনা-আপনি খিদে লাগার অনুভুতি নষ্ট করে দেয়। তাছাড়া ক্ষুধার অনুভুতি কম বা বেশি হয় পাকস্থলী থেকে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে আমাদের কোলন কেবল হজমের জন্য ব্যাবহার হয় না বরং এটি মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি কথা বলতে পারে। ক্ষুধা এবং পরিতৃপ্তির সংকেতকে প্রভাবিত করে ওজন কমানো বা বাড়ানোর কাজে সরাসরি অংশগ্রহন করতে পারে!