অনলাইন মিটিং, ডেডলাইন আর ব্যস্ত রুটিন… সব মিলিয়ে অফিস ও বাসায় অনেকেই এখন খাবার খেতে খেতেই কম্পিউটারের সামনে বসে পড়েন। পুষ্টিবিদ ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অভ্যাস দীর্ঘমেয়াদে হজমের সমস্যা, ওজন বেড়ে যাওয়া, গ্যাস্ট্রিক অথবা অ্যাসিডিটি সমস্যা, রিপিটেটিভ স্ট্রেইন ইঞ্জুরি এবং মনোযোগ বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি বাড়ায়। একই সঙ্গে বাড়ে ডিভাইস দূষণ (জীবাণু জমা) ও অপ্রত্যাশিতভাবে ডাটা-ক্র্যাশ/ডিভাইস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাও।
আমরা যখন স্ক্রিনের সামনে বসে খাই, তখন খাবারের স্বাদ, গন্ধ বা টেক্সচারের প্রতি আমাদের মনোযোগ থাকে না। এর ফলে মস্তিষ্ক ঠিকমতো বুঝতে পারে না যে আমরা কি পরিমাণে খাচ্ছি, যার কারণে প্রায়ই অতিরিক্ত খাওয়া হয়ে যায়। এই অভ্যাস দীর্ঘমেয়াদী ওজন বৃদ্ধিতে সরাসরি ভূমিকা রাখে।
ডা: কেট লিয়াং, কিংস কলেজ লন্ডনের ডায়েটেটিক্স গবেষক
কেন ঝুঁকি?
- মানসিক চাপ ও মনোযোগের ঘাটতি: কাজের চাপ মাথায় নিয়েই খাওয়া শেষ করলে মস্তিষ্ক ‘বিরতি’ পায় না। এতে করে স্ট্রেস লেভেল কমে না। কর্মক্ষমতা সাময়িক বাড়লেও দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
- মাইন্ডলেস ইটিং (Mindless Eating): স্ক্রিনে মনোনিবেশ থাকার কারণে কতটা খাচ্ছেন, কী খাচ্ছেন তা বোঝা কঠিন হয়। এর কারণে প্রায়শই খাবারের পরিমাণ মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া বা অস্বাস্থ্যকর স্ন্যাকসের দিকে ঝুঁকে পড়ি আমরা।
- হজমে ব্যাঘাত: তাড়াহুড়ো করে বা সোজা হয়ে না বসে খেলে হজম প্রক্রিয়া প্রভাবিত হয়। অতিরিক্ত অ্যাসিডিটি/রিফ্লাক্সের ঝুঁকি বাড়ে। তাচাড়া আমাদের খাবার হজম হওয়া শুরু করে আমাদের মুখ থকে। পর্যাপ্ত চিবিয়ে না খেলে হজমের সমস্যা খাবার খাওয়ার সময় থেকেই শুরু হয়।
- ভঙ্গিমার সমস্যা: লাঞ্চের সময় ল্যাপটপের সামনে ঝুঁকে বসার ফলে ঘাড়, কাঁধ ও কোমরে ব্যথা দেখা দিতে পারে।
- স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা ঝুঁকি: কিবোর্ড/মাউসের ওপর খাবারের কণা পড়ে জীবাণু বৃদ্ধি পায়। পরেরবার হাত না ধুয়ে ডিভাইস ছোঁয়া মানে জীবাণু সহজেই ছড়ানো। গবেষণায় দেখা গেছে আপনার কমোডে যে পরিমাণ জীবানু থাকে তার চাইতে কিবোর্ডে বেশি জীবাণু থাকতে পারে।

কী করবেন?
- টাইমার ব্যবহার করুন: কাজের মাঝে নির্দিষ্ট সময়ে উঠে খেয়ে আসার জন্য এলার্ম নির্ধারন করতে পারেন।
- খাওয়ার জন্য আলাদা সময় বের করুন: ১৫–২০ মিনিটের জন্য হলেও স্ক্রিন থেকে দূরে গিয়ে খান।
- ডেস্ক-ফ্রি মিল পলিসি (নিজের জন্য): অন্তত দিনে একটি মূল খাবার স্ক্রিনবিহীন রাখুন অর্থাৎ কম্পিউটার, টিভি, মোবাইল ফোনের সামনে বসে খাবেন না।
- পোশ্চার ঠিক রাখুন: খাবার খাওয়ার সময় সোজা হয়ে বসুন, খাবারের পাত্র ডেস্কের সমতলে রাখুন, কিবোর্ড থেকে দূরে রাখুন।
- মাইন্ডফুল ইটিং অনুশীলন করুন: খাবারের স্বাদ, গন্ধ ও টেক্সচারের দিকে মন দিন – এতে মাত্রাতিরিক্ত খাওয়া কমে।
- হাত ধোয়া ও ডিভাইস পরিষ্কার: খাবারের আগে-পরে হাত ধুতে ভুলবেন না; নিয়মিত কিবোর্ড/মাউস পরিষ্কার করুন।
- হালকা স্ন্যাকসের বদলে ব্যালান্সড মিল: প্রোটিন, ফাইবার, স্বাস্থ্যকর ফ্যাটসহ পুষ্টিসম্মত খাবার বেছে নিন।
কর্মক্ষেত্রে কীভাবে মাইন্ডফুল থাকা যায়?
- অফিসে স্ক্রিন-ফ্রি ক্যান্টিন বা লাঞ্চস্পেসে খাবার খান। প্যানট্রি বা খাবারের জন্য আলাদা ব্যাবস্থা না থাকলে প্রয়োজনে এমন কোথাও যেয়ে খাবার খান যেখানে কম্পিউটার নেই। প্রায় প্রতিটি অফিসে বারান্দা, খোলা ছাদ কিংবা অন্তত একটি কমন রুম থাকে। তাও পাওয়া না গেলে কম্পিউটার মনিটর বন্ধ করে ডেস্কে বসেই খেতে পারেন।
- প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে লাঞ্চ করুন। লাঞ্চ ব্রেকের সময় ফোন ধরবেন না।
- মিটিং শিডিউলে “লাঞ্চ ব্রেক” রাখার জন্য অনুরোধ করুন।
শেষ কথা
খাবার শুধু পুষ্টি ও ক্যালোরি নয়, বরং শরীর ও মস্তিষ্ককে বিরতি দিয়ে পুনরুজ্জীবিত করার একটি প্রক্রিয়া। কাজের চাপ ও ডিজিটাল লাইফস্টাইল আমাদের সেই বিরতি কেড়ে নিচ্ছে। আর অসচেতন খাবার অভ্যাস বা মাইন্ডলেস ইটিং হতে পারে নানা রকম রোগের উৎস। তাই সচেতনভাবে খাওয়ার সময়কে স্ক্রিনমুক্ত রেখে, অল্প সময়ের জন্য হলেও শরীর ও মন দুটোকেই একটু বিরতি দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ। এজন্যই প্রবাদে আছে, “বিশ্রাম কাজের অঙ্গ এক সাথে গাঁথা, নয়নের অংশ যেমন নয়নের পাতা।”