পর্তুগাল ও বাংলাদেশ দুটি ভিন্ন মহাদেশ ও ভিন্ন সংস্কৃতির দেশ হলেও ইতিহাসের পাতায় রয়েছে এক বিস্মৃতপ্রায় গল্প যা এই দুই জাতির মধ্যকার দূরত্ব যে একদিন অনেক কমে এসেছিল তার প্রমাণ বহন করে চলেছে। ১৫শ শতকে পর্তুগিজরা যখন ভারতবর্ষের উপকূলীয় অঞ্চলে পদার্পণ করল তখন তাদের নজরে পড়ে তৎকালীন ঐশ্বর্যশালী বাংলা অঞ্চলের সম্পদ ও অতিথিপরায়ন মানুষ। আস্তে আস্তে তারা তাদের কার্যক্রম প্রাচীন বাংলা জনপদে প্রসারিত করে। সেই সময় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পর্তুগিজদের জানাশোনা গড়ে ওঠে। সেই সময়টায় পর্তুগিজ নাবিক, বণিক ও মিশনারিরা বাঙালিদের ভাষা ও সাহিত্যকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করতে থাকে।
তৎকালীন সময়ে পর্তুগিজরা বাংলায় তৈরি ধর্মীয় ও বাণিজ্যিক পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেছিল, যেগুলো আজও পর্তুগালের বিভিন্ন লাইব্রেরি ও আর্কাইভে সংরক্ষিত রয়েছে। এই দলিলগুলো বাংলা ভাষার প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক অমূল্য সম্পদ। এসময় আন্তঃসংযোগের কারণে পর্তুগিজ ভাষায় বেশ কিছু বাংলা শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে। ঠিক যেমনভাবে বাংলায় আলমারি, আনারস, বালতি, তোয়ালে, জানালা, কুয়াশা ইত্যাদি পর্তুগিজ শব্দ প্রবেশ করে।
আশ্চর্যের বিষয়, আজও পর্তুগিজ ভাষায় কিছু বাংলা শব্দ বহুল ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে পোশাক, খাদ্য এবং দৈনন্দিন জীবনের কিছু শব্দ বাংলা থেকেই এসেছে। যেমন:
- জামা : বাংলা শব্দ যা পোশাক বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। পর্তুগিজ ভাষায়ও ‘জামা’ শব্দটি পোশাক অর্থে এসেছে।
- পটাকা: বাংলা শব্দ ‘পটাকা’ অর্থাৎ আতশবাজি, পর্তুগিজ ভাষায় আগুনের খেলা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
- গুড়: মিষ্টি জাতীয় খাবার গুড় বা মোলাসেজ বোঝাতে পর্তুগিজে প্রায়ই এই শব্দ হয়।
- তামার: তেঁতুলের মতো টক কিছু খাবারের নাম, যা বাংলা থেকে এসেছে।
এছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন ভাষা থেকে পর্তুগিজে কিছু শব্দ এসেছে, যার মধ্যে বাংলার প্রভাব সামান্য হলেও আছে। এই ভাষাগত সংমিশ্রণ প্রমাণ করে দুই সংস্কৃতির মাঝে শতাব্দী পুরোনো একটা বন্ধন রয়েছে।
বর্তমানে পর্তুগালে বসবাসকারী বাংলাদেশি প্রবাসীদের মাধ্যমে বাংলা ভাষার সংস্কৃতিগত উপস্থিতি শক্তিশালী হচ্ছে। নানা সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় উৎসব, বাংলা ভাষায় সাহিত্য ও সঙ্গীত অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে স্থানীয় পর্তুগিজদের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। ফলে বাংলা ভাষার প্রভাব শুধু ঐতিহাসিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না, বরং এখন তা পর্তুগিজ সমাজেও একটি ছোট্ট কিন্তু ক্রমবর্ধমান সাংস্কৃতিক অংশ হয়ে উঠেছে। যেমন ধরুন আজকাল প্রায়ই জোশ নামক উর্বান স্ল্যাংটি পর্তুগাল প্রবাসী বাংগালী শিক্ষার্থিদের কল্যানে পর্তুগিজ বন্ধুরা প্রায়শই ব্যাবহার করছেন।